বিভাবনায় লিখতে পারেন যে-কেউ

বাংলা ভাষা, ব্যাকরণ, উচ্চারণ বানান নিয়ে যে-কেউ লিখতে পারেন এই ব্লগে। এসব বিষয়ে কারও কোনো প্রশ্ন থাকলে তাও লিখতে পারেন। আমরা আলোচনার মাধ্যমে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।

শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১২

বাংলা ভাষা বিষয়ক টিপস-১০ : কয়েকটি শব্দের ভুল বা অপপ্রয়োগ


সম্ভাবনা/আশঙ্কা
সম্ভাবনা আর আশঙ্কা শব্দ দুটোর ব্যবহারে আমরা মাঝে মাঝেই তালগোল পাকিয়ে ফেলি। শঙ্কা থেকে আশঙ্কা শব্দটি এসেছে। কোনো কাজের খারাপ ফল হতে পারে বোঝাতে আশঙ্কা শব্দটি ব্যবহার করা উচিত। আর ভালো কিছু হতে পারে বোঝালে সম্ভাবনা শব্দটি ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু ধরনের বাক্য আমরা ইদানীং আকছার ব্যবহার হতে দেখি :
তাড়াতাড়ি কাজ করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বেপরোয়া গতিতে গাাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
পাওনা টাকা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
খেয়াল করুন, প্রথম বাক্য দুটোতে সম্ভাবনা শব্দটির ভুল ব্যবহার করা হয়েছে।

উদ্দেশ/উদ্দেশ্য
উদ্দেশ শব্দের অর্থ প্রতি, হদিস, দিকে। তার পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে উত্সর্গ করা হল। গত এক সপ্তাহ তার কোনো উদ্দেশ নেই (হদিস নেই)
উদ্দেশ্য শব্দের অর্থ অভিপ্রায়, লক্ষ্য, তাত্পর্য, প্রয়োজন। পড়ালেখার উদ্দেশ্য টাকা কামানো নয়, জ্ঞানার্জন। লোকটার উদ্দেশ্য সুবিধার মনে হচ্ছে না।
আমাদের আজকালকার অনেক তথাকথিত লেখক মনে করেন, বাংলা বানান, শব্দপ্রয়োগ, ব্যাকরণের দিকে খেয়াল করতে গেলে তারা টাল সামলাতে পারবেন না। তাতে তাদের লেখার মান নষ্ট হবে। অথচ রবীন্দ্রনাথ সেই কবে লিখে গেছেন নিরুদ্দেশের পথিক, আমায় ডাক দিলে কি... খেয়াল করুন, তিনিনিরুদ্দেশ্যেরলেখেননি। আর বাংলার দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে টালও হারাননি তিনি।

লক্ষ/লক্ষ্য
লক্ষ্য শব্দের অর্থ উদ্দেশ্য বা নিশানা। এই অর্থে শব্দটিতে -ফলা দিতে হয়। যেমন : সরকারের প্রধান লক্ষ্য দেশের দারিদ্র্য বিমোচন। সবারই লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশের উন্নতি করা। লক্ষ্য অর্থে ব্যবহার সত্ত্বেও শব্দটি যখন ক্রিয়াপদ হবে তখন -ফলা থাকে না। শুধু গল্প না করে আশপাশে কিছুটা লক্ষ রেখো।

পৌঁছে/পৌঁছয়
পৌঁছে শব্দটি একটি অসমাপিকা ক্রিয়া। অনেক ক্ষেত্রেই সমাপিকা ক্রিয়া হিসেবে এর ভুল ব্যবহার দেখা যায়। পারাবত ট্রেনটি রাত ১০টায় ঢাকায় পৌঁছে। এটি ভুল প্রয়োগ। সঠিক প্রয়োগ হবে, পারাবত ট্রেনটি রাত ১০টায় ঢাকায় পৌঁছয়। আবার : ট্রেনটি রাত আটটায় ভৈরব পৌঁছে ১০ মিনিট বিরতি নেয়।

ওঠে/উঠে
ওঠে সমাপিকা ক্রিয়া এবং উঠে অসমাপিকা ক্রিয়া। সে রোজ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। আবার : সে রোজ ভোরে উঠে ব্যায়াম করে। উড়ে আর ওড়ে শব্দ দুটিও ঠিক একইভাবে ব্যবহার করতে হয়। পাখিটি উড়ে তার বাসায় চলে গেল। পাখিরা আকাশে ওড়ে।

উল্লিখিত
ওপরে বা আগে লিখিত হয়েছে অর্থে উল্লেখিত শব্দের ব্যবহার ভুল, লেখা উচিত উল্লিখিত। উল্লেখিত শব্দের অর্থ উল্লেখকৃত। উপরোল্লিখিত শব্দটি হাস্যকর রকমভাবে ভুল। উল্লিখিত (উত্+লিখিত) মানেই হচ্ছে উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যা।
উপরোক্ত না লিখে উপর্যুক্ত বা উপরি-উক্ত লেখা উচিত।

ফলশ্রুতি
ফলশ্রুতি শব্দের অর্থ পুণ্যকর্ম করলে যে ফল হয় তা শ্রবণ বা তার বিবরণ। ফল বা পরিণাম অর্থে ফলশ্রুতি ব্যবহার না করে ফলে লেখা উচিত।

সহসা/শিগগির
সহসা শব্দের অর্থ হঠাত্। প্রধানমন্ত্রী সহসাই ভুটান সফরে যাবেন। বাক্যটির অর্থ হবে, প্রধানমন্ত্রী হঠাত্ করেই ভুটান সফরে যাবেন। আসলে প্রধানমন্ত্রীরা হঠাত্ করে খুব কম প্রোগ্রামই করেন। তাই বাক্যটি হবে-প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই ভুটান সফরে যাবেন। শিগগির অর্থে সহসা শব্দের প্রয়োগ ভুল। অথচ সংবাদপত্রেও শব্দটির ভুল ব্যবহার অনেক সময়ই চোখে পড়ে।

বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

বানান বিষয়ক টিপস-৯ : বহুবচনের দ্বিরুক্তি


ইংরেজি এবং অন্য কোনো কোনো ভাষায় যেমন সংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশেষ্য পদের বচন পাল্টে যায়, বাংলার ক্ষেত্রে নিয়মটা কিন্তু এর উল্টো। বাংলায় বহুবচনের দ্বিরুক্তি ব্যাকরণগত দিক দিয়ে ভুল। ইংরেজিতে A Book, Two Books ব্যাকরণসম্মত। বাংলায় কিন্তু একটি বই এবং দুটি বই- লিখতে হবে। দুটি বইগুলো কোনোমতেই বিধেয় নয়। নিয়মটা অনেকেরই জানা থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই সামান্য অসতর্কতার কারণে তালগোল পাকিয়ে যায়। তাইতো অনেকেই লেখেন-অন্যান্য বক্তাগণ..., সব কর্মকর্তারা..., যাবতীয় নিয়মাবলি..., সেইসব গানগুলো..., এইসব মানুষেরা..., কতিপয় লোকেরা..., যেসমস্ত বাচ্চারা... ইত্যাদি। শুদ্ধভাবে এগুলো লিখলে দাঁড়াবে-অন্যান্য বক্তা... অথবা অন্য বক্তাগণ..., সব কর্মকর্তা..., যাবতীয় নিয়ম..., সেইসব গান... অথবা সেই গানগুলো..., এসব মানুষ... অথবা এই মানুষেরা..., কতিপয় লোক..., যেসমস্ত বাচ্চা... ইত্যাদি। এমনিভাবেছোট ছোট পাখিগুলো গাছের ডালে বসে কিচির মিচির শব্দ করছিল। না লিখে লেখা উচিত, ‘ছোট ছোট পাখি গাছের ডালে বসে কিচির মিচির শব্দ করছিল। সামান্য সতর্ক থাকলেই ধরনের ভুলগুলো এড়ানো সম্ভব।

বুধবার, ২৮ মার্চ, ২০১২

বানান বিষয়ক টিপস-৮ : বিরামচিহ্ন


দাঁড়ি, কমা, কোলন, সেমিকোলন এসব চিহ্ন কখন কোথায় ব্যবহার করতে হয় তা আমাদের সবারই মোটামুটি জানা আছে। কিন্তু কিছু কিছু বিরামচিহ্ন বসাতে গিয়ে অনেকেই সমস্যায় পড়েন। সেরকম কয়েকটি বিরামচিহ্নের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বিসর্গ/কোলন
বিসর্গ () লম্বালম্বিভাবে অবস্থিত ক্ষুদ্রাকার দুটি বৃত্ত। এটি একটি বর্ণ। অন্যদিকে কোলন (:) লম্বালম্বিভাবে অবস্থিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুটি বিন্দু। এটি একটি যতিচিহ্ন। একটির ক্ষেত্রে অন্যটির ব্যবহার কঠোরভাবে বর্জন করা উচিত। কিন্তু অনেকেই দুটোর ব্যবহার ঠিকমতো করতে পারেন না। অথবা দুটো যে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস সেদিকে খেয়াল রাখেন না। তাদের ধারণা, যে-কোনো একটা দিলেই কাজ চলে যাবে।
বিসর্গ বাংলা অনেক শব্দগঠনের প্রয়োজনীয় বর্ণ। যেমন, নিঃস্ব, অন্তঃস্থ, ইতঃপূর্বে, দুঃস্বপ্ন ইত্যাদি। যদিও পদান্তের বিসর্গ এখন আর ব্যবহার করা হয় না। যেমন, কার্যতঃ, প্রধানতঃ না লিখে এখন লেখা হয় কার্যত, প্রধানত। বাংলা শব্দসংক্ষেপ করতেও বিসর্গ ব্যবহার করা হয়। যেমন মোহাম্মদ-এর সংক্ষেপ মোঃ। এভাবে আঃ (আবদুল), সাঃ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), দঃ (দরুদ) ইত্যাদি। ইংরেজিতে মূলত ফুলস্টপ (.) দিয়ে শব্দসংক্ষেপ করা হয়। ডক্টর না লিখে . লেখা যায়, তেমনি লে. জে. (লেফটেন্যান্ট জেনারেল) ইত্যাদি। তবে ইদানীং অনেকে বাংলা শব্দও ফুলস্টপ দিয়ে সংক্ষেপ করেন। এটা অনুচিত হলেও আগামীতে হয়তো মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। যেমন, মোহাম্মদ-এর সংক্ষেপ মোঃ না লিখে অনেকেই লিখছেন মো. তবে এক্ষেত্রে বিসর্গের জায়গায় কোলন কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। মোঃ না লিখে মো: কোনোভাবেই চলবে না।

হাইফেন/ড্যাশ
হাইফেন ড্যাশ দুটোই আড়াআড়ি সরলরেখা। তবে ড্যাশ  আকারে হাইফেনের  তিনগুণ। বাংলা ফন্ট যারা তৈরি করেছেন তাদের অসতর্কতার কারণে যারা দুটোর ব্যবহার জানেন তাদের জন্যও সমস্যা হয়ে যায় এই জন্য যে অধিকাংশ ফন্টেই দুটো প্রায় কাছাকাছি সাইজে বানানো হয়েছে। ড্যাশ যদি হয় বারো এম তবে হাইফেন হওয়া উচিত চার এমন। কিন্তু অধিকাংশ বাংলা ফন্টে ড্যাশ ছয় এমের ওপর নেই। যার জন্য ড্যাশ ব্যবহার করলেও এগুলোকে হাইফেনই মনে হয়। দৈনন্দিন কাজ এটি দিয়ে চালিয়ে নেওয়া গেলেও কোনো ভালো প্রকাশনার বারোটা বাজিয়ে দেয় এই ড্যাশ। বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে। তাই ড্যাশ যখন ব্যবহার করবেন ফন্ট যদি সেটা সাপোর্ট না করে তবে ম্যানুয়ালি ড্যাশটাকে বড় করে দিন। এমএস ওয়ার্ডে ফর্ম্যাট মেনুর ফন্টে গিয়ে স্কেলিং ২০০ বা ২৫০ পার্সেন্ট করে দিন। কোয়ার্কএক্সপ্রেস বা অন্য কোনো প্রোগ্রাম ব্যবহার করলে সেখানেও স্কেলিং চেইঞ্জ করার ব্যবস্থা আছে। ড্যাশ এবং হাইফেনের কোনোদিকেই কোনো স্পেস ব্যবহার করা উচিত না।

উদ্ধৃতি-চিহ্ন
অতিরিক্ত উদ্ধৃতি-চিহ্ন ব্যবহারের প্রবণতা আছে অনেকেরই। এটা ঠিক নয়। তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। এখানে যদি লেখা হয়, তিনিস্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন, তবে বুঝতে হবে এটা আসলে স্ত্রী নয়, এর ভেতর অবশ্যই কোনো কিন্তু আছে। তাই অতিরিক্ত উদ্ধৃতি-চিহ্ন ব্যবহার না করাই ভালো। অনেকে ইংরেজি শব্দ পেলেই উদ্ধৃতিচিহ্ন দিয়ে সেটিকে আটকে দেন। এটাও ঠিক নয়। যেখানে উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহার না করলে উদ্ধৃতাংশ বুঝতে অসুবিধা হয় শুধু সেখানেই উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহার করা উচিত। উদ্ধৃতিচিহ্ন যদি দুটি ঊর্ধ্বকমা (“) দিয়ে শুরু হয় সেটি শেষও হবে দুটি ঊর্ধ্বকমা (”) দিয়ে। উদ্ধৃতির মধ্যে উদ্ধৃতি থাকলে সেখানে একটি উদ্ধৃতি-চিহ্ন বসানো যায়। বাক্যের ভেতরে বাক্যাংশ উদ্ধৃত হলে যতিচিহ্নের আগে উদ্ধৃতিচিহ্ন বসবে। যেমন, ঢাকাকে বলা হয়মসজিদের শহর
কোনো কোনো সময় তিনটি ঊর্ধ্বকমা একসঙ্গে ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে। সভার প্রধান অতিথি বললেন, “‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’- বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে আমরা সেদিন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। এভাবেও হতে পারে, সভার প্রধান অতিথি বললেন, “বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য শুনে আমরা সেদিন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’”
কোনো উদ্ধৃতিতে অনেকগুলো প্যারাগ্রাফ থাকলে প্রতিটি প্যারাগ্রাফের শুরুতে উদ্ধৃতি-চিহ্ন ব্যবহার করতে হয়, কিন্তু শেষ করতে হয় একদম শেষ প্যারাগ্রাফের শেষে।