বিভাবনায় লিখতে পারেন যে-কেউ

বাংলা ভাষা, ব্যাকরণ, উচ্চারণ বানান নিয়ে যে-কেউ লিখতে পারেন এই ব্লগে। এসব বিষয়ে কারও কোনো প্রশ্ন থাকলে তাও লিখতে পারেন। আমরা আলোচনার মাধ্যমে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।

বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ, ২০১২

বানান-প্রসঙ্গ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

একঘরে পত্রিকায় (সাহিত্য পরিষত্ পত্রিকা, ১৩০৫, তৃতীয় সংখ্যা) চণ্ডিদাসের যে নূতন পদাবলী প্রকাশিত হইতেছে তাহা বহুমূল্যবান।... সম্পাদক মহাশয় আদর্শ পুঁথির বানান সংশোধন করিয়া দেন নাই সেজন্য তিনি আমাদের ধন্যবাদভাজন। প্রাচীন গ্রন্থসকলের যে-সমস্ত মুদ্রিত সংস্করণ আজকাল বাহির হয় তাহাতে বানান-সংশোধকগণ কালাপাহাড়ের বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছেন। তাঁহারা সংস্কৃত বানানকে বাংলা বানানের আদর্শ কল্পনা করিয়া যথার্থ বাংলা বানান নির্বিচারে নষ্ট করিয়াছেন; ইহাতে ভাষাতত্ত্বজিজ্ঞাসুদিগের বিশেষ অসুবিধা ঘটিয়াছে। বর্তমান-সাহিত্যের বাংলা বহুলপরিমাণে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদিগের উদ্ভাবিত বলিয়া বাংলা বানান, এমন-কি, বাংলাপদবিন্যাস প্রণালী তাহার স্বাভাবিক পথভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে, এখন তাহাকে স্বপথে ফিরাইয়া লইয়া যাওয়া সম্ভবপর নহে। কিন্তু আধুনিক বাংলার আদর্শে যাঁহারা প্রাচীন পুঁথি সংশোধন করিতে থাকেন তাঁহারা পরম অনিষ্ট করেন।

বানান লইয়া কয়েকটি কথা বলিতে ইচ্ছা করি। রাঙা ভাঙা ডাঙা আঙুল প্রভৃতি শব্দ ঙ্গ-অক্ষরযোগে লেখা নিতান্তই ধ্বনিসংগতিবিরুদ্ধ। গঙ্গা শব্দের সহিত রাঙা, তুঙ্গ শব্দের সহিত ঢ্যাঙা তুলনা করিলে কথা স্পষ্ট হইবে। মূল শব্দটিকে স্মরণ করাইবার জন্য ধ্বনির সহিত বানানের বিরোধ ঘটানো কর্তব্য নহে। সে নিয়ম মানিতে হইলে চাঁদকে চান্দ, পাঁককে পঙ্ক, কুমারকে কুম্ভার লিখিতে হয়। অনেকে মূলশব্দের সাদৃশ্যরক্ষার জন্য সোনাকে সোণা, কানকে কাণ বানান করেন, অথচ শ্রবণশব্দজ শোনাকে শোণা লেখেন না। যে-সকল সংস্কৃত শব্দ অপভ্রংশের নিয়মে পুরা বাংলা হইয়া গেছে সেগুলির ধ্বনি অনুযায়িক বানান হওয়া উচিত। প্রাকৃতভাষার বানান ইহার উদাহরণস্থল। জোড়া, জোয়ান, জাঁতা, কাজ প্রভৃতি শব্দে আমরা স্বাভাবিক বানান গ্রহণ করিয়াছি, অথচ অন্য অনেক স্থলে করি নাই। [সাহিত্য-পরিষত্] পত্রিকা-সম্পাদকমহাশয় বাংলা বানানের নিয়ম সম্বন্ধে আলোচনা উত্থাপন করিলে আমরা কৃতজ্ঞ হইব।

টেক্সট্বুক্কমিটি ক্ষকারকে বাংলা বর্ণমালা হইতে নির্বাসন দিয়াছেন। শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ অনেক পুরাতন নজির দেখাইয়া ক্ষকারের পক্ষে ওকালতি করিয়াছেন। অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের দলে ক্ষ কেমন করিয়া প্রথমে প্রবেশ করিয়াছিল জানি না। কিন্তু সে সময়ে দ্বাররক্ষক যে সতর্ক ছিল, তাহা বলিতে পারি না। আধুনিক ভারতবর্ষীয় আর্যভাষায় মূর্ধন্য -এর উচ্চারণ হইয়া গিয়াছিল, সুতরাং ক্ষকারে মূর্ধন্য -এর বিশুদ্ধ উচ্চারণ ছিল না। না থাকিলেও উহা যুক্ত অক্ষর এবং উহার উচ্চারণ ক্খ। শব্দের আরম্ভে অনেক যুক্ত অক্ষরের যুক্ত উচ্চারণ থাকে না, যেমন জ্ঞান শব্দের’; কিন্তু শব্দে উহার যুক্ত উচ্চারণ সম্বন্ধে সন্দেহ থাকে না। ক্ষকারও সেইরূপক্ষয় এবং অক্ষয় শব্দের উচ্চারণে তাহা প্রমাণ হইবে। অতএব অসংযুক্ত বর্ণমালায় ক্ষকার দলভ্রষ্ট তাহাতে সন্দেহ নাই। সেই ব্যঞ্জনপঙ্ক্তির মধ্যে উহার অনুরূপ সংকরবর্ণ আর একটিও নাই। দীর্ঘকালের দখল প্রমাণ হইলেও তাহাকে আরো দীর্ঘকাল অন্যায় অধিকার রক্ষা করিতে দেওয়া উচিত কি।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সংকলনে আপনারা বানানের যে রীতি বেঁধে দিয়েছেন আমি তাহার সমর্থন করি। ব্যবহারকালে নিয়মের কিছু কিছু পরিবর্তন অনিবার্য হতে পারে। এইজন্যে বছর দুয়েক পরে পুনঃসংশোধন প্রয়োজন হবে বলে মনে করি।
য়ুরোপীয় লিখিত ভাষা থেকে লিপ্যন্তরকালে অকারবর্গীয় স্বরবর্ণের বাংলারূপ নিয়ে আপনারা আলোচনা করেছেন। বিশেষ চিহ্নযোগ না করে সকল স্থানে এই উচ্চারণ বিশুদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। বক্র বোঝাবার জন্যে আপনারা বিশেষ চিহ্ন স্বীকার করেছেন কিন্তু বাংলায় অপ্রচলিত বিকৃত অকারের কোনো চিহ্ন স্বীকার করেন নি। Love শব্দকে লভ্লিখলে হাস্যোদ্রেক করবে, লাভ লিখলেও যথাযথ হবে না। apathy, recur, such প্রভৃতি শব্দের চিহ্নিত ধ্বনিগুলিকে কি বাংলা অকার দিয়ে ব্যবহার করা চলবে। অপথি এবং অপথিকরি কি একই বানানে চালানো যাবে এবং অক্ষরের কোন্প্রতিলিপি আপনারা স্থির করেছেন জানি নে। আমার মতে অন্ত্যস্থ , এবং অন্ত্যস্থ ভ। award এবং averse বানানে দুই পৃথক অক্ষরের প্রয়োজন। সম্ভবত আপনারা সমস্তই আলোচনা করে স্থির করে দিয়েছেন।
কিন্তু প্রবাসী পত্রিকায় আপনি যে প্রবন্ধ পাঠিয়েছেন তার মধ্যে আমি একটি গুরুতর অভাব দেখলেম। বর্তমান বাংলাসাহিত্যে প্রাকৃত বাংলার ব্যবহার ব্যাপকভাবেই চলেছে আমার এই চিঠিখানি তার একটি প্রমাণ। অন্তত চিঠিলেখায় সংস্কৃত বাংলা প্রায় উঠে গেছে বলেই আমার বিশ্বাস। বাংলা গদ্যসাহিত্যে এই প্রাকৃত ভাষার ব্যাপ্তি অনেকের কাছে রুচিকর না হতে পারে কিন্তু একে উপেক্ষা করা চলবে না। এর বানানরীতি নির্দিষ্ট করে দেবার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকদিন আমি অনুরোধ করেছি। প্রাচীনকালে যখন প্রাকৃত ভাষা সাহিত্যে গৃহীত হল তখন তার বানানে বা ব্যাকরণে যথেচ্ছাচার অনুমোদিত হয় নি, হলে ভাষার সাহিত্য গড়তে পারত না। সিটি কলেজের বাংলা অধ্যাপক শ্রীযুক্ত বিজনবিহারী ভট্টাচার্য কিছুকালের জন্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশক্রমে বাংলাভাষাসংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে আমার এখানে কাজ করতেন। ভিন্ন ভিন্ন বাংলা গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন লেখক প্রাকৃত বাংলারচনায় বানানের যেরকম নানা বিচিত্র বিসদৃশ ব্যবহার করেছেন তার তালিকা প্রস্তুত করতে তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেম। আমার ইচ্ছা ছিল এই তালিকা অবলম্বন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাকৃত বাংলা বানানের নিয়ম বেঁধে দেবেন। সকলেই জানেন প্রাকৃত বাংলায় সমাপিকা অসমাপিকা ক্রিয়ার বানান আজকাল উচ্ছৃঙ্খলভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকেআমিও সম্বন্ধে অপরাধী। অপেক্ষা করে আছি প্রাকৃত বাংলার এই বানান ব্যাপারে আমার মতো পথহারাদের জন্যে বিদ্যাবিধানের কর্তৃপক্ষ পাকা রাস্তা বেঁধে দেবেন। সম্বন্ধে আর তাঁরা উদাসীন থাকতে পারেন না যেহেতু বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে প্রাকৃত বাংলার প্রবেশ তাঁরা নিষেধ করতে পারবেন না। প্রশ্নপত্রের উত্তরে পরীক্ষার্থীরা প্রাকৃত বাংলা অবলম্বন করতে পারে এমন অধিকার তাঁরা দিয়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষক নিজেদের বিশেষ রুচি অভ্যাস-অনুসারে ছাত্রদের বানান প্রভৃতির যদি বিচার করেন তবে পরীক্ষার্থীদের প্রতি গুরুতর অবিচারের আশঙ্কা আছেনির্বিচারে যথেচ্ছাচারের প্রশ্রয় দেওয়াও চলবে না
এই গুরুতর বিষয় প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার উপযোগী আমার শরীরের অবস্থা নয়। সংক্ষেপে আমার বক্তব্যের আভাসমাত্র দিলেম। (চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে লিখিত পত্র)

প্রাকৃত বাংলার বানান সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত কোনো চরম অভ্যাসে আসতে পারি নি। তাড়াতাড়িতে অমনোযোগ তার একটি কারণ। তা ছাড়া বই ছাপাবার সময় প্রুফ দেখার সম্যক ভার নিজে নেবার মতো ধৈর্য বা শক্তি বা সময় নেইকাজেই আমার ছাপা বইগুলিতে বানান সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টতার পরিচয় পাওয়া যায় না। এই কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্য দাবি করেছিলুম। তাঁরা দশে মিলে যেটা স্থির করে দেবেন সেটা নিয়ে আর দ্বিধা করব না। (দিলীপকুমার রায়কে লিখিত পত্র)

আমাদের সাহিত্যে প্রাকৃত বাংলার প্রচলন প্রতিদিন বেড়ে উঠেছে। সেই বাংলায় বানান সম্বন্ধে কোনো আইন নেই, তাই স্বেচ্ছাচারের অরাজকতা চলেছে। যারা হবেন প্রথম আইনকর্তা তাঁদের বিধান অনিন্দনীয় হতেই পারে না, তবু উচ্ছৃঙ্খলতার বাঁধ বেঁধে দেবার কাজ তো শুরু করতেই হবে। সেইজন্যে বিশ্ববিদ্যালয়েরই শরণ নিতে হল। কালক্রমে তাঁদের নিয়মের অনেক পরিবর্তন ঘটবে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই পরিবর্তনের গতি একটা সুচিন্তিত পথ অনুসরণ যদি না করে তা হলে অব্যবস্থার অন্ত থাকবে না। নদীর তট বাঁধা আছে তবু তার বাঁক পরিবর্তন হয়, কিন্তু তট না থাকলে তার নদীত্বই ঘুচবে, সে হবে জলা।
আমার প্রদেশের নাম আমি লিখি বাংলা। হসন্ত - চিহ্ন ং। যেমন হসন্ত -য়ের চিহ্নবাঙ্গলামুখে বলি নে লিখতেও চাই নে। যুক্তবর্ণ ঙ্গ- হসন্ত চিহ্ন নিরর্থক। - সঙ্গে হসন্ত চিহ্ন দেওয়া চলে, কিন্তু দরকার কী, হসন্ত চিহ্ন যুক্ত - স্বকীয়রূপ তো বর্ণমালায় আছেসেই অনুস্বরকে আমি মেনে নিয়ে থাকি।

শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে লেখায় চিহ্ন বর্জন সম্বন্ধে আমার মত প্রকাশ করেছি। নিত্য-ব্যবহারে আমার মত চলবে না তা জানি। এটা একটা আলোচনার বিষয় মাত্র। চিহ্নগুলোর প্রতি অতিমাত্র নির্ভরপরতা অভ্যস্ত হলে ভাষায় আলস্যজনিত দুর্বলতা প্রবেশ করে এই আমার বিশ্বাস। চিহ্নসংকেতের সহায়তা পাওয়া যাবে না কথা যদি জানি তবে ভাষার আপন সংকেতের দ্বারাতেই তাকে প্রকাশবান করতে সতর্ক হতে পারি; অন্তত আজকাল ইংরেজির অনুকরণে, লিখিত ভাষাগত ইঙ্গিতের জন্যে চিহ্নসংকেতের অকারণ বাড়াবাড়ি সংযত হতে পারে। এই চিহ্নের প্রশ্রয় পেয়ে পাঠসম্বন্ধে পাঠকদেরও মন পঙ্গু হয় প্রকাশ-সম্বন্ধে লেখকদেরও তদ্রূপ। কোনো কোনো মানুষ আছে কথাবার্তায় যাদের অঙ্গভঙ্গি অত্যন্ত বেশি। সেটাকে মুদ্রাদোষ বলা যায়। বোঝা যায় লোকটার মধ্যে সহজ ভাবপ্রকাশের ভাষাদৈন্য আছে। কিন্তু কথার সঙ্গে ভঙ্গি একেবারে চলবে না কথা বলা অসংগত তেমনি লেখার সঙ্গে চিহ্ন সর্বত্রই বর্জনীয়
এমন অনুশাসনও লোকে মানবে না। (শ্যামদাস লাহিড়ীকে লিখিত পত্র)

প্রাকৃত বাংলার বানান সম্বন্ধে আমার একটা বক্তব্য আছে। ইংরেজি ভাষার লিখিত শব্দগুলি তাদের ইতিহাসের খোলস ছাড়তে চায় নাতাতে করে তাদের ধ্বনিরূপ আচ্ছন্ন। কিন্তু ভারতবর্ষে প্রাকৃত পথের অনুসরণ করে নি। তার বানানের মধ্যে অবঞ্চনা আছে, সে যে প্রাকৃত, পরিচয় সে গোপন করে নি। বাংলা ভাষার ষত্বণত্বের বৈচিত্র্য ধ্বনির মধ্যে নেই বললেই হয়। সেই কারণে প্রাচীন পণ্ডিতেরাও পুঁথিতে লোকভাষা লেখবার সময় দীর্ঘহ্রস্ব ষত্বণত্বকে সরল করে এনেছিলেন। তাঁদের ভয় ছিল না পাছে সেজন্য তাঁদের কেউ মূর্খ অপবাদ দেয়। আজ আমরা ভারতের রীতি ত্যাগ করে বিদেশীর অনুকরণে বানানের বিড়ম্বনায় শিশুদের চিত্তকে অনাবশ্যক ভারগ্রস্ত করতে বসেছি।
ভেবে দেখলে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ একেবারেই নেই। যাকে তত্সম শব্দ বলি উচ্চারণের বিকারে তাও অপভ্রংশ পদবীতে পড়ে। সংস্কৃত নিয়মে লিখি সত্য কিন্তু বলি শোত্তো। মন শব্দ যে কেবল বিসর্গ বিসর্জন করেছে তা নয় তার ধ্বনিরূপ বদলে সে হয়েছে মোন্ এই যুক্তি অনুসারে বাংলা বানানকে আগাগোড়া ধ্বনিঅনুসারী করব এমন সাহস আমার নেইযদি বাংলায় কেমাল পাশার পদ পেতুম তা হলে হয়তো এই কীর্তি করতুমএবং সেই পুণ্যে ভাবীকালের অগণ্য শিশুদের কৃতজ্ঞতাভাজন হতুম। অন্তত তদ্ভব শব্দে যিনি সাহস দেখিয়ে ষত্বণত্ব দীর্ঘহ্রস্বের পণ্ডপাণ্ডিত্য ঘুচিয়ে শব্দের ধ্বনিস্বরূপকে শ্রদ্ধা করতে প্রবৃত্ত হবেন তাঁর আমি জয়জয়কার করব। যে পণ্ডিতমূর্খরাগভর্ণমেন্ট্‌” বানান প্রচার করতে লজ্জা পান নি তাঁদেরই প্রেতাত্মার দল আজও বাংলা বানানকে শাসন করছেনএই প্রেতের বিভীষিকা ঘুচবে কবে? কান হোলো সজীব বানান, আর কাণ হোলো প্রেতের বানান কথা মানবেন তো? বানান সম্বন্ধে আমিও অপরাধ করি অতএব আমার নজীর কোনো হিসাবে প্রামাণ্য নয়। (রাজশেখর বসুকে লিখিত পত্র)

নীচ শব্দ সংস্কৃত, তাহার অর্থ Mean বাংলায় যেনিচেকথা আছে তাহা ক্রিয়ার বিশেষণ। সংস্কৃত ভাষার নীচ শব্দের ক্রিয়ার বিশেষণ রূপ নাই। সংস্কৃতে নিম্নতা বুঝাইবার জন্য নীচ কথার প্রয়োগ আছে কিনা জানি না। হয়তো উচ্চ নীচ যুগমশব্দে এরূপ অর্থ চলিতে পারেকিন্তু সে স্থলেও যথার্থত নীচ শব্দের তাত্পর্য Moral তাহা Physical নহে। অন্তত আমার সেই ধারণা। সংস্কৃতে নীচ নিম্ন দুই ভিন্নবর্গের শব্দ-উহাদিগকে একার্থক করা যায় না। এইজন্য বাংলায় নীচে বানান করিলে below না বুঝাইয়া to the mean—বুঝানোই সংগত হয়। আমি সেইজন্যনিচেশব্দটিকে সম্পূর্ণ প্রাকৃত বাংলা বলিয়াই স্বীকার করিয়া থাকি। প্রাচীন প্রাকৃতে বানানে যে রীতি আছে আমার মতে তাহাই শুদ্ধরীতি; ছদ্মবেশে মর্যাদাভিক্ষা অশ্রদ্ধেয়। প্রাচীন বাংলায় পণ্ডিতেরাও সেই নীতি রক্ষা করিতেন, নব্য পণ্ডিতদের হাতে বাংলা আত্মবিস্মৃত হইয়াছে।
পুঁথিশব্দের চন্দ্রবিন্দুর লোপে পূর্ববঙ্গের প্রভাব দেখিতেছি, উহাতে আমার সম্মতি নাই।লুকাচুরিশব্দের বানানলুকোচুরিহওয়াই সংগত; উহার স্বভাব নষ্ট করিয়া উহার মধ্যে কৃত্রিম ভদ্রভাব চালাইবার চেষ্টা সাধু নহে। (সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য বেদান্তশাস্ত্রীকে লিখিত পত্র)

১০
বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-বিধির সম্বন্ধে দুটিমাত্র আপত্তি। কখনো কোনো আমারি তোমারি আজো প্রভৃতি শব্দে অন্তস্বর যুক্ত থাকিবে। দ্বিতীয়, ছোটো বড়ো কালো ভালো প্রভৃতি বিশেষণ পদের অন্তস্বর লোপ করা অবৈধ হবে বলে মনে করি। (কিশোরীমোহন সাঁতরাকে লিখিত পত্র)

১১
হইয়ো, করিয়োতেলাগিয়ো। রানীতে ঈ। গয়লানী প্রভৃতি শব্দে আমি দীর্ঘ দিই নে তার কারণ প্রত্যয় সংস্কৃত প্রত্যয় নয়। এক হিসাবে প্রাকৃত বাংলায় স্ত্রীলিঙ্গের প্রত্যয় নেই। আমরা বিড়ালীও বলি নে বেড়ালনীও বলি নে, কুকুরীও বাংলা নয়, কুকুরনীও নয়। বাঘিনী বলি, উটনী বলি নে। বাঘিনী সংস্কৃত ব্যাকরণ মতে শুদ্ধ নয়। বামনী বলি কিন্তু বদ্যিনী বলি নে, কায়েনী বলি। বস্তুত বাঘিনী ছাড়া কোনো জন্তু-শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ বাংলায় দুর্লভ। পাঁঠী আছে, ভেড়ী বলে কিনা জানি নে; হাঁস, কাক, পায়রা (মুরগী আছে) কোকিল দোয়েলে স্ত্রীলিঙ্গ প্রত্যয় বর্জিত। বাংলায় যদি সাধারণ কোনো প্রত্যয় থাকত তা হলে সর্বত্রই খাটত। এইজন্যে আমি বাংলা স্ত্রীজাতিসূচক কথাগুলিকে খাস বাংলা নিয়মেই ব্যবহার করতে চাইখাস বাংলা হচ্ছে হ্রস্ব ই। সংস্কৃত ইন্প্রত্যয়ের যেখানে নকল করি সেখানেও আমার মন সায় দেয় না; যেমন ইংরেজি, ফারসি ইত্যাদি। তত্সম শব্দে দীর্ঘ দিতে আমরা বাধ্যকিন্তু তদ্ভব শব্দে আমাদের স্বরাজ খাটবে না কেন? (কিশোরীমোহন সাঁতরাকে লিখিত পত্র)

২টি মন্তব্য:

  1. বিভাবনায় স্বাগতম। বিভাবনায় আসুন, বাংলা ভাষা নিয়ে বিভাবনায় আলোচনায় যোগ দিন।

    নতুন নামে চিনলাম। আপনাকে চিনতে আর কত নাম মনে রাখতে হবে আল্লাই মালুম, ভাই কবি আবুল।

    উত্তরমুছুন